বাংলাদেশের দক্ষিণে নীল পানির বুকে ভেসে থাকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ—নারিকেল গাছের ছায়ায় স্বর্গের অনুভূতি পেতে এখানে ছুটে আসেন পর্যটকেরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই দ্বীপ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। কেউ বলছেন, এখানে নৌঘাঁটি হবে। আবার কেউ বলছেন, সরকার পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চায়। এসব কথার সত্য-মিথ্যা যাচাই করার আগে আসুন, একটু গভীরভাবে বিষয়টি বুঝি।
পর্যটন নীতিমালা: নতুন নিয়মে কতটা যৌক্তিকতা?
সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, সেন্ট মার্টিনে পর্যটনে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে।
- নভেম্বর: পর্যটক যেতে পারবেন, কিন্তু রাতে থাকতে পারবেন না।
- ডিসেম্বর ও জানুয়ারি: প্রতিদিন মাত্র ২,০০০ জন যেতে পারবেন এবং রাতে থাকতে পারবেন।
- ফেব্রুয়ারি: পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ।
সারা বছর কী হবে? সরকার তা এখনো স্পষ্ট করেনি। তবে এই নীতিমালা কার্যত বছরের ১০ মাস সেন্ট মার্টিনে পর্যটন বন্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটা দ্বীপে এত কড়াকড়ি কেন? সরকারের দাবি, সেন্ট মার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পরিবেশের সংকট: সমস্যা কোথায়?
সরকারের ভাষ্যমতে, পর্যটকদের লাগামহীন আনাগোনায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ধ্বংসের মুখে।
- দ্বীপের তাপমাত্রা বাড়ছে।
- বনজ সম্পদ এবং কচ্ছপের বাসস্থান হুমকির মুখে।
- প্লাস্টিক ও ময়লার দূষণে দ্বীপের মিঠাপানির সংকট চরমে।
- সাদা মাছি নামে একধরনের ক্ষতিকর কীট পুরো দ্বীপে গাছপালা ধ্বংস করছে।
তাই পরিবেশ রক্ষায় পর্যটনে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
পর্যটন বন্ধ: ক্ষতির মুখে স্থানীয়রা
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষা করা জরুরি, এ কথা ঠিক। কিন্তু বছরের ১০ মাস পর্যটন বন্ধ করে দিলে দ্বীপের বাসিন্দাদের কী হবে?
- স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় সবাই পর্যটন খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
- দেশের প্রায় ৫ লাখ পর্যটন ব্যবসায়ী সেন্ট মার্টিনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
পর্যটনের সময়সীমা এভাবে সংকুচিত হলে ব্যবসায়ীরা বছরের চার থেকে পাঁচ মাসের আয় দিয়ে পুরো বছর চলতে পারবেন না। ফলে দ্বীপের বাসিন্দারা পেশা পরিবর্তনের জন্য শহরমুখী হতে বাধ্য হবেন।
নভেম্বর মাসে যদি রাতে থাকার অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহলে কেউ ২০ ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমণ করে দ্বীপে গিয়ে বিকেলেই ফিরে আসতে চাইবে না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মাত্র ২,০০০ জনের সীমা আরোপের কারণে ভ্রমণের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
ফলাফল? সেন্ট মার্টিন একসময় শুধু ধনী পর্যটকদের বিলাসবহুল কেন্দ্রে পরিণত হবে।
নৌঘাঁটির গুঞ্জন: কতটা ভিত্তিহীন?
সেন্ট মার্টিনে মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের গুঞ্জন নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দ্বীপে এমন ঘাঁটি তৈরির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বা পানির গভীরতা নেই।
সরকারও জানিয়েছে, কোনো দেশের কাছে সেন্ট মার্টিনকে লিজ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, এমনকি মাছ ধরা বন্ধের মতো পদক্ষেপ জনমনে সন্দেহ বাড়িয়েছে।
পরিবেশ বনাম পর্যটন: টেকসই সমাধান কী?
পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া কি সঠিক সমাধান? বরং কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
- পরিবেশবান্ধব আইন: পলিথিন বা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা।
- জরিমানা ও সচেতনতা: দূষণ করলে উচ্চ জরিমানা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
- সারা বছর পর্যটন উন্মুক্ত রাখা: পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণ করে টেকসই নীতিমালা তৈরি করা।
- কমিউনিটি ট্যুরিজম: স্থানীয় বাসিন্দাদের পরিবেশ রক্ষায় প্রশিক্ষিত করা।
- পর্যটনের সুযোগ বিস্তৃত করা: উন্নত জাহাজ এবং নিরাপদ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা।
স্থানীয়দের মতামত জরুরি
সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা বছরের পর বছর ধরে এই দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা করে আসছেন। কোনো নীতিমালা কার্যকর করার আগে তাদের মতামত নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থানীয়দের বাদ দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত জনমনে অসন্তোষ তৈরি করবে।
সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা দ্বীপের সবচেয়ে বড় রক্ষক। তাদের সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণের কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না।
উপসংহার: সন্দেহ নয়, সমাধান দরকার
সারা পৃথিবীতে এমন অনেক সংবেদনশীল দ্বীপ রয়েছে যেখানে পরিবেশ রক্ষা এবং পর্যটন একসঙ্গে চলে। সেন্ট মার্টিনেও তা সম্ভব।
পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যটন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারকে এমন নীতিমালা করতে হবে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা এবং দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুটোই রক্ষা করে। কারণ দ্বীপের প্রকৃতির সুরক্ষা এবং মানুষজনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে টেকসই উন্নয়নের সঠিক পথ।