বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
Google search engine
Homeআন্তর্জাতিকযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট: আদৌ কি পররাষ্ট্রনীতির নায়ক নাকি কেবল একটি শীর্ষ পদ?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট: আদৌ কি পররাষ্ট্রনীতির নায়ক নাকি কেবল একটি শীর্ষ পদ?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা কখনোই থামে না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ সরাসরি প্রভাব ফেলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসলে কতটা ক্ষমতাধর? ট্রাম্পের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা রিপাবলিকান দলের মতো শক্তিশালী দলও কি দেশটির দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে?


পররাষ্ট্রনীতি: শুধু কৌশল, নাকি বৃহৎ পরিকল্পনা?

পররাষ্ট্রনীতি মূলত একটি দেশের বহির্বিশ্বে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ। এটি একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়া, যা বহুমুখী অংশগ্রহণের মাধ্যমে তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এটি আরও জটিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস, এবং জনমতের ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি গড়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের “এক্সিকিউটিভ পাওয়ার” থাকলেও কংগ্রেসের মাধ্যমে তাকে প্রায়শই ক্ষমতার ভারসাম্যে রাখা হয়। অর্থাৎ, একজন প্রেসিডেন্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই জনমত, দলের নীতি এবং কংগ্রেসের বাধার মুখোমুখি হন। তাই প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প বা তার দল পররাষ্ট্রনীতির কতটা বদলাতে পারবে?


জনগণের চাহিদা: যুক্তরাষ্ট্র কী চায়?

২০২৪ সালের মার্কিন জনগণের অগ্রাধিকার কী, তা বোঝার জন্য পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপ আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়। সেখানে দেখা যায়:

  1. সন্ত্রাসী হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করা (৭৩%)।
  2. দেশে অবৈধ মাদক নিয়ন্ত্রণ (৬৪%)।
  3. গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বৃদ্ধি রোধ।
  4. বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা।
  5. সংক্রামক রোগের প্রকোপ দমন।

এই তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মার্কিন জনগণের অগ্রাধিকার মূলত নিরাপত্তা ও সামরিক আধিপত্যের সঙ্গে জড়িত। জনগণের এমন মনোভাব থাকলে, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসা কঠিন।


রাজনৈতিক দল ও পররাষ্ট্রনীতি: ইতিহাস কী বলে?

হাভার্ডের গবেষক ভারল্যান লুইস ১৯০০-২০০৯ পর্যন্ত ১০৯ বছরের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, যে দল ক্ষমতায় ছিল, তারা সবসময়ই বেশি আগ্রাসী ছিল। ক্ষমতার বাইরে থাকা দল তুলনামূলকভাবে হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলার পক্ষে মত দিয়েছে।

যেমন:

  • রিপাবলিকানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সময়কালে বেশি হস্তক্ষেপের পক্ষে ছিল।
  • ডেমোক্র্যাটরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং শীতল যুদ্ধের সময় আরও আগ্রাসী ছিল।
  • বুশ প্রশাসনের “ওয়ার অন টেরর” এবং ওবামার “ড্রোন স্ট্রাইক” নীতিও দলগুলোর আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ।

এই ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, রিপাবলিকানদের আমলে সামরিক আধিপত্য এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে। কিন্তু “কৌশল” বদলালেও “মূলনীতি” রয়ে যায় একই।


ডোনাল্ড ট্রাম্প: বদল না কি ধারাবাহিকতা?

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগের মেয়াদে (২০১৬-২০২০) কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যেমন:

  • ন্যাটো মিত্রদের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় চাপ প্রয়োগ।
  • চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ।
  • ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসা।

ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা। এবারও তিনি ক্ষমতায় এলে এই নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সম্ভাবনা বেশি।

তবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন সম্ভব কি না, তা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং কংগ্রেসের ভূমিকার ওপর।


বন্ধুরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক ভারসাম্য

যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্রের তালিকায় রয়েছে:

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ন্যাটো)।
  • এশিয়ার শক্তিধর মিত্ররা (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত)।
  • মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো (ইসরায়েল, সৌদি আরব, আরব আমিরাত)।

এই দেশগুলোর স্বার্থ মেনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। যেমন:

  • ন্যাটো মিত্রদের জন্য রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করা।
  • এশিয়ায় চীনের ক্ষমতা দমন।
  • মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং সৌদি নেতৃত্বাধীন স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

এই স্বার্থগুলো থেকেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ভূমিকাটি ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে ঐতিহাসিক এবং কৌশলগত বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে বাধ্য।


উপসংহার: কতটা বদলাতে পারবেন প্রেসিডেন্ট?

ইতিহাস এবং বর্তমান বাস্তবতা থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চাইলেই পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারেন না। জনগণের চাহিদা, রাজনৈতিক দল, এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের স্বার্থ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে।

ট্রাম্প হোক বা অন্য কেউ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য—বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখা—অপরিবর্তিত থাকবে। পরিবর্তন শুধু কৌশলগত হবে, কিন্তু কাঠামোগত নয়।

তাই প্রশ্নের উত্তর সহজ: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পররাষ্ট্রনীতির মুখ হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু নীতির মূল স্থপতি হওয়ার সুযোগ কম।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments